খুলনা, বাংলাদেশ | ৩০ ভাদ্র, ১৪৩১ | ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ফুটবল ফেডারেশন নির্বাচন ২৬ অক্টোবর, অংশ নেবেন না টানা ১৬ বছরের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন
  সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ছেলে সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি গ্রেপ্তার
  ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ৮৭৫ : এইচআরএসএস

দেবর-ভাবীর দ্বন্দ্বে অশান্ত সেনহাটি

একরামুল হোসেব লিপু, দিঘলিয়া

স্থগিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থী দেবর ভাবীর দ্বন্দ্বের কারণে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি ইউনিয়ন ক্রমান্বয়ে অশান্ত হয়ে উঠছে। দেবর হচ্ছে ঐ ইউনিয়নের চন্দনীমহল গ্রামের প্রভাবশালী গাজী বংশের সন্তান। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবীও একই বংশের পুত্রবধূ। দু’জনেই বসবাস করছেন চন্দনীমহল গাজী পাড়ায়। দু’ জনেই বসবাস করছেন মাত্র দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ গজের মধ্যে।

দেবর হচ্ছে বর্তমান সেনহাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ও স্থগিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী গাজী জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া গাজী। ভাবী হচ্ছে চন্দনীমহল গাজী বংশের প্রাণপুরুষ দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা, দুর্বৃত্তের হাতে নিহত প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান গাজী আব্দুল হালিমের সহধর্মিনী ফারহানা হালিম। যিনি খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও স্থগিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী।

ওই ইউনিয়নের পথের বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চন্দনীমহল ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ইয়াসিন শেখ (৪২) গত ২৫ জুলাই রাতে খুন হন । তিনি ফারহানা হালিমের সমর্থক ছিলেন। আর এ হত্যা মামলায় গাজী জিয়াউর রহমানকে আসামী করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজী জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া গাজী স্টার জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে স্টার জুট মিলের শ্রমিক নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে আসছে চন্দনীমহলের প্রভাবশালী গাজী বংশ। সর্বশেষ গাজী বংশের নেতৃত্বদানকারী গাজী আব্দুল হালিমের মৃত্যুর পর জিয়া গাজী লাইম লাইটে চলে আসেন এবং স্টার জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী রাজনীতির মেরুকরণের কারণে গত ইউপি নির্বাচনে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার আশীর্বাদ লাভ করেন। তাঁর বদৌন্নতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অপরিচিত মুখ গাজী জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া গাজী বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাকে পিছনে ফেলে সেনহাটী ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন এবং চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

ঐ নির্বাচনে ফারহানা হালিম দলীয় মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সন্মান দেখিয়ে মনোনীত প্রার্থী দেবর জিয়া গাজীকে সমর্থন দেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর জিয়া গাজী নিজ বংশ এবং এলাকার সর্বত্র প্রভাব বিস্তার শুরু করে। এ সময় তিনি তাঁর ভাবীকে ভবিষ্যতে ইউপি নির্বাচনের শক্তিশালী প্রার্থী এবং প্রতিপক্ষ মনে করে তাঁর অনুগত সমর্থকদের নানাভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেন।

এদিকে, ৫ বছর চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্কিত অনেক কর্মকান্ডের অভিযোগ ওঠে। এমনকি তার বিরুদ্ধে সরকারি চাল আত্নসাতের অভিযোগও ওঠে। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগের মামলা তাঁর বিরুদ্ধে দুদকে চলমান আছে।

সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই রাতে পথেরবাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চন্দনীমহল ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ইয়াসিন শেখকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার পরিকল্পায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ইতিমধ্যে গত ২৭ জুলাই দায়ের করা এ হত্যা মামলায় তাকে আসামী করা হয়েছে।

নিজ বংশ এবং এলাকায় কিছুটা প্রভাব বিস্তারে সফল হলেও দলে তিনি কোন ভালো অবস্থান বা পদে ছিলেন না। দলে তার অবস্থান ছিলো ওয়ার্ড কমিটির একজন কার্যকরী সদস্য হিসেবে। স্থগিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়ার গত ২১ মার্চ চন্দনীমহল সাংগঠনিক ইউনিয়ন শাখার এক বিশেষ বর্ধিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে তাকে এবং তার দুই সহযোগী ঐ সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বিল্লাল মল্লিক, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ মাহামুদুল হাসানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গত দুইদিন ধরে তাঁর ব্যবহৃত ০১৭১৭২৮৪৬৬২ মোবাইল নং এ কল করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এদিকে ফারহানা হালিমের স্বামী প্রয়াত খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক প্রাক্তন চেয়ারম্যান গাজী আঃ হালিমের মৃত্যুর পর তার জনপ্রিয়তাকে পূঁজি করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হন। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং জেলা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। এছাড়া স্বামী গাজী আঃ হালিম সেনহাটী ইউপির চেয়ারম্যান থাকাকালীন ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর দুর্বৃত্তের হাতে গুলিবিদ্ধ এবং ২ নভেম্বর সন্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহত হন। তার মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া সেনহাটী ইউপির উপ-নির্বাচনে তিনি এ ইউনিয়নের বিএনপির প্রার্থী ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান আঃ রকিব মল্লিককে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তিনি নানা চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। স্থগিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। ফারহানা হালিম দলীয় মনোনয়ন পেলেও জিয়া গাজী বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বহাল থাকেন। ইতিপূর্বে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বাঁধা দু’জনের পরোক্ষ বিরোধ এরপর থেকে প্রকাশ্য রুপ লাভ করে।

গত ১৫ এপ্রিল রাতে দু’গ্রুপের সমর্থকরা বড় ধরণের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ঐ সংর্ষের ঘটনায় উত্তর চন্দনীহল (বোগদিয়া) এবং চন্দনীমহল গ্রামের জিয়া গাজীর সমর্থক বেশ কয়েকজন মারাত্মক আহত হন। অভিযোগ রয়েছে এ ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবেই গত ২৫ জুলাই রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয় হয় ফারহানা হালিমের সমর্থক ইয়াসিন শেখকে।

দু’পক্ষের বিরোধ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আলোর মিছিলের উপদেষ্টা, প্রাক্তন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন সেনহাটী ইউপি সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ আব্দুস সালামের কাছে। তিনি বলেন, “দেবর ভাবীর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক নিরীহ মানুষ হামলা, মামলা এবং পুলিশী হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন। দু’জনের এ বিরোধকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় একটি পক্ষ তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল নিয়েছে। তাদের দু’জনের বিরোধ দ্রুত মেটানো সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে এলাকায় বড় ক্ষয়ক্ষতির আশংকা প্রকাশ করেন”।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় অফিসার ইনচার্জ (দিঘলিয়া) মোঃ আহসান উল্লাহ চৌধুরীর সংগে। তিনি বলেন, ‘‘এলাকার আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যিনিই ঘটাক তিনি যে কোন দলেরই হোক, যত বড়ই শক্তিশালী হোক, আমরা কাউকে ছাড় দিবো না। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মহাদয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে”।

গাজী জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া গাজী এবং ফারহানা হালিমের সাথে সম্পর্ক শুধু দেবর ভাবী নয়। তাদের ভীতর আত্নীয়তার সম্পর্কও বিদ্যমান। ফারহানা হালিমের প্রয়াত স্বামী গাজী আব্দুল হালিমের আপন চাচাত ভাই হায়দার গাজী বিয়ে করেছেন জিয়া গাজীর বোনকে।

 

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!